যে কারনে ইফতারিতে ফলের রস খাবেন
শুধু রোজার সময়ই নয়, যেকোনো সময় ক্লান্তি দূর করতে ফলের জুস বা শরবতের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের ইফতার শুরু হয় পানীয় দিয়ে। ইফতারের শুরুতে লেবু বা ট্যাংয়ের শরবত পান করা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। ফলের রস পানীয় হিসেবে রাখা যেতে পারে, যা স্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে পেঁপে, বেল, আনারস, তরমুজ ও স্ট্রবেরি বেশি উপকারী।
মিল্কশেক বা মিল্কশেক সরাসরি ফলের রস না খেয়ে টক দই বা দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। সেক্ষেত্রে এই পানীয়ের গুণাগুণ বাড়বে। তবে চিনি বা গুড় যোগ করা যাবে না।
ফলের উপাদান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চিনি, সামান্য প্রোটিন, সামান্য চর্বিসহ সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পেঁপে 8 শতাংশ, আনারসে 14, তরমুজে 13, বালি 30 এবং স্ট্রবেরিতে 13 শতাংশ চিনি রয়েছে। তাই আলাদা চিনির প্রয়োজন নেই।
ফলের রস কেন উপকারী?
● দীর্ঘায়িত
উপবাস শরীরের সুগার লেভেল কমিয়ে দেয়। ফলের চিনি ধীরে
ধীরে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে সতেজ করে।
● ফলের
রস ইলেক্ট্রোলাইটের অভাবের কারণে ক্লান্ত এবং দুর্বল পেশীকে
সতেজ করে। এটিতে পটাসিয়াম,
সোডিয়াম, ক্লোরাইড এবং বাইকার্বোনেটের চমৎকার
সংমিশ্রণ রয়েছে।
● ফলের
জলীয় অংশ শরীরের পানিশূন্যতা
প্রতিরোধ করে, শরীরের তাপমাত্রা
ভারসাম্য রাখে।
● অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যাল
তৈরিতে বাধা দেয়। মৃত
কোষ দূর করে। ফলে
কোষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বৃদ্ধি পায়।
● ফলের
ফাইবার আপনাকে মূত্রনালীর সংক্রমণ বা কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে
মুক্ত রাখে। এটি প্রোবায়োটিক হিসেবেও
কাজ করে, যা হজমশক্তির
উন্নতি ঘটায়।
● ফলের
বিটা ক্যারোটিন চোখ, চুল ও
ত্বক রক্ষা করে।
● ফলের
ভিটামিন সি আয়রনের শোষণ
বাড়িয়ে রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
● ফলের
আয়রন, ভিটামিন B-12 এবং ফলিক অ্যাসিড
লোহিত রক্ত কণিকা গঠনে
সাহায্য করে।
ইফতারে কি খাবেন?
দীর্ঘ
রোজা রাখার পর রোজা ভাঙার
সময় অবশ্যই হালকা খাবার খেতে হবে। এ
সময় ভারী খাবার খেলে
হজমের সমস্যা হবে। তাই ফল
খেতে পারেন।
এটি
শরীরে পানির অভাব দূর করার
পাশাপাশি পুষ্টি ও ভিটামিনের ঘাটতি
পূরণ করবে। খেজুরের মতো ফাইবার সমৃদ্ধ
ফল দিয়ে রোজা ভঙ্গ করা
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুন্নত এবং
সেই সাথে শরীরে শক্তি
যোগায়। খেজুরে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, চিনি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, কপার, সিলিকন, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গানিজ এবং সালফার। খেজুরে
প্রতি 100 গ্রামে 66 ক্যালোরি থাকে।
আপনি
কলা খেতে পারেন, একটি
কলায় প্রায় 105 ক্যালরি থাকে যা আপনাকে
দুর্বল করে তুলবে না।
ইফতারের তালিকায় পেয়ারা, আপেল ও তরমুজও
রাখতে পারেন।
প্রতি
100 গ্রাম পেয়ারায় 68 ক্যালোরি, প্রতি 100 গ্রাম আপেলে 45 ক্যালোরি এবং 100 গ্রাম তরমুজে 30 ক্যালোরি রয়েছে। কমলা এবং মাল্টা
আমরা প্রায়শই খাই। উভয় ফলই
পুষ্টিগুণে প্রায় একই রকম হলেও
মাল্টা বেশি জনপ্রিয়। এতে
রয়েছে বিটা ক্যারোটিন যা
কোষের ক্ষতি প্রতিরোধ করে। মাল্টায় থাকা
ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁত
মজবুত করে এবং ম্যাগনেসিয়াম
ও পটাশিয়ামের পাশাপাশি হার্টের অনেক সমস্যা দূর
করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই ইফতারিতে থাকতে
পারে এক গ্লাস মাল্টার
জুস।
রোজা
রাখার সময় ডিহাইড্রেশন হওয়ার
সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই সাধারণ পানির
পাশাপাশি বোতলজাত পানি পান করতে
পারেন। এটি শুধুমাত্র ডিহাইড্রেশনের
ঝুঁকি কমায় না, অনেক শারীরিক
সুবিধাও দেবে। পানিশূন্যতা কমাতে তরমুজ, শসা, পেয়ারাসহ সব
ধরনের রসালো ফল খেতে পারেন।
ইফতারিতে
নরম ভাত বা দইও
খেতে পারেন। বদহজমের কোনো সুযোগ থাকবে
না। প্রচণ্ড ক্ষুধায়ও স্বস্তি পাবেন। মনে রাখবেন যে
প্রতি 100 গ্রাম দইতে প্রায় 257 ক্যালোরি
থাকে।
আপনার
হজমের সমস্যা বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা
থাকলে সাধারণ পানীয় ও শরবতের সাথে
গরম দুধের সাথে এগুলো খেতে
পারেন।
ইফতারে
একদম ভাজা হয় না।
আমরা যে ছোলা সেদ্ধ
করে মসলা দিয়ে ভাজা
খাই সেগুলো কাঁচা অবস্থায় ভিজিয়ে রাখলে স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী।
তবে
ইফতারের খাদ্য তালিকায় প্রোটিন যাতে বাদ না
পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু আমরা
দীর্ঘ সময় ধরে রোজা
রাখি এবং দীর্ঘ এক
মাস ধরে এটি পালন
করি, তাই এই নির্দিষ্ট
সময়ের জন্য আমাদের একটি
নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা থাকা দরকার। তালিকায়
সুষম খাবার থাকতে হবে।
ইফতারের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার (সম্ভাব্য তালিকা)
তারিখগুলি
- খেজুর
- মাল্টা বা কমলা
- তরমুজ ও পেয়ারা
- ডাবের
পানি
- ফলের জুস
- পাকা
পেপে
- দই ও চিড়া
- কাঁচা ছোলা
- ইসবগুল ও লেবুর শরবত
- আতব চালের জাও
- পুডিং
- বিশুদ্ধ পানি
সবশেষে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি। তবে একবারে বেশি পানি না খাওয়াই ভালো। আমরা যদি অল্প অল্প করে পানি পান করি তাহলে আমাদের শরীরের পরিপাকতন্ত্র সঠিকভাবে খাবার হজম করতে এবং পুষ্টি শোষণ করতে সক্ষম হবে। এ সময় অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
ইফতারে কী ধরনের খাবার খাবেন না?
অবশ্যই
চেষ্টা করবেন ইফতারে কোনো ধরনের পোড়া
পোড়া ও অতিরিক্ত মিষ্টি
খাবার না খাওয়ার। তৈলাক্ত
মশলা এবং ভাজা পোড়া
খাবার খালি পেটে খুবই
ক্ষতিকর। তাছাড়া রোজা রাখার ফলে
আপনার শরীর থেকে যে
পরিমাণ চিনি (সুগার) কমে যায় তা
আবার মিষ্টি খাবার খেলে প্রতিস্থাপিত হবে,
ফলে ডায়াবেটিসসহ নানা সমস্যা বাড়তে
পারে।
তবে
মিষ্টি খেতে চাইলে মিষ্টি
ফল খেতে পারেন। তেলে
ভাজা খাবার খেতে হলে খেয়াল
রাখতে হবে যেন একই
তেলে বারবার কিছু না ভাজা
এবং অল্প তেলে ভাজা।
আমরা ভাজা পোড়া ছাড়া
খুব ভালো মানের সুস্বাদু
ইফতার করতে পারি যা
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
মধ্যরাতের খাবার
রোজা
ভাঙার পর ইফতার ও
সেহরির মধ্যবর্তী খাবারকে আমরা মধ্যরাতের খাবার
হিসেবে বিবেচনা করি। মধ্যরাতের খাবার
একেবারে বাধ্যতামূলক নয়।
আমাদের
মধ্যে বেশিরভাগই মধ্যরাতের জলখাবার খাই না। কিন্তু
বেশিরভাগ মানুষই খায়। তাই মধ্যরাতের খাবারে
বিশেষ কিছু বিষয়ে আমাদের
সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সহজে হজম
হয় না বা গ্যাস
ও অ্যাসিড সৃষ্টি করতে পারে এমন
খাবার খাওয়া উচিত নয়।
এ ক্ষেত্রে ঠিক কী খাবেন
তা কখনই বলা যায়
না। তবে একটা কথা
বলতেই হবে যে আপনার
শরীরের উপযোগী খাবার খেতে হবে। কারণ
সেহরির সময় আমরা একটু
ভারী খাবার খাই তাই মধ্যরাতে
হালকা খাবার খাওয়া উচিত।
খাবারে
যেন বেশি করে সবজি
থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অ্যাসিড বা
গ্যাস থাকলে সেহরির সময় খেতে অসুবিধা
হবে। সেহরির সময় খাবারে গণ্ডগোল
হলে অবশ্যই রোজা রাখা খুব
কঠিন হবে। তাই মধ্যরাতের
খাবার হিসেবে অল্প পরিমাণে ভাত
বা রুটি, সবজি, মাছ, ডিম ইত্যাদি
খেতে পারেন।
সেহরিতে কি খাওয়া উচিত?
আমরা
অনেকেই সেহরির সময় ভারী খাবার
খেয়ে থাকি। আসলে এটা আমাদের
অভ্যাস, কিন্তু এটা উচিত নয়।
আমরা সাধারণত দুপুরে যে পরিমাণ খাবার
খাই সেহরিতে তার ব্যতিক্রম হওয়া
উচিত নয়।
সেহরির সম্ভাব্য খাবারের তালিকা
- ভাত, মাছ (ছোট মাছ হলে বেশি ভালো)
- মাংস
(কম
চর্বিযুক্ত) ও শাক ভাজি ( কম তেলে ভাজা)
- দুধ ও ডিম
- ডাল ও ঘি
সেহরিতে যা খাবেন তা যেন কম তৈলাক্ত, নোনতা এবং মশলাদার হয়। আপনার শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী যেকোনো খাবার খেতে পারেন। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ঘি ও গরুর মাংস এড়িয়ে চলতে পারেন।
সেহরির
পর চা বা কফি
না খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। পেট
না ভরে তিন-চতুর্থাংশ
খাবার খেলে গ্যাস ও
অ্যাসিডিটি এড়িয়ে চলুন। এতে খাবার দ্রুত
হজম হবে এবং অস্বস্তি
হবে না।
আপনার
সেহরি ডায়েটে আমিষ জাতীয় খাবার
যোগ করুন যাতে আপনি
খুব তাড়াতাড়ি ক্ষুধার্ত না হন এবং
আমিষের ঘাটতি না পান। আমিষের
ঘাটতি হলে শরীরে গ্লুকোজের
ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে
আপনি খুব দ্রুত দুর্বল
হয়ে পড়বেন।
পবিত্র
রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর
জন্য একটি বরকতময় মাস।
ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে চলার পাশাপাশি
স্বাস্থ্য সচেতনতার দিক থেকেও খাদ্য
তালিকার দিকে নজর দিতে
হবে।
অসুস্থ
শরীরে পূজা করা কঠিন।
তাই শারীরিক সুস্থতার জন্য উল্লিখিত খাদ্য
তালিকা আপনাকে সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে এবং সংযম বজায়
রাখতে সাহায্য করবে।
রমজান
মাসে আপনি কিভাবে সুস্থ
থাকতে পারবেন সেই বিবেচনায় যতটা
সম্ভব তথ্য দেওয়ার চেষ্টা
করেছি। কোন তথ্য ভুল
মনে হলে বা আরও
তথ্য যোগ করলে ভালো
হবে বলে মনে হলে
কমেন্ট করুন।
রমজান
সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে চাইলে
প্রশ্ন করতে পারেন। আমি
আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব দ্রুত উত্তর
দিতে। তুমি নিশ্চয়ই রোজা
রাখবে। আপনার কি কোনো শারীরিক
সমস্যা আছে? আপনি যদি
আমাকে বলেন, আমি অবশ্যই এটি
সম্পর্কে একটি নতুন নিবন্ধ
লেখার অনুপ্রেরণা পাব।
আপনি
সুস্থ থাকুন, রোজা রাখুন, ঈশ্বর
আপনার সংযমের মাধ্যমে আপনাকে সাহায্য করুন। আমেন
রমজানে খাবারের ব্যাপারে ধর্মীয় বিধিনিষেধ আছে কি?
না, নেই। তবে সব সময় হালাল ও স্বাস্থ্যকর খাবার থাকে। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া সুন্নত। তাই রাসুল (সাঃ) এর পথ্য অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব।
সতর্কতা
● যাদের
আইবিএস বা ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা
রয়েছে তাদের মিল্কশেক এড়ানো উচিত।
● কিডনি
রোগীদের জন্য
ফলের রস খাওয়ার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের
কাছে পরামর্শ নিবেন।
মো. ইকবাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল
0 মন্তব্যসমূহ